
সাংবাদিকতার উন্নতি ও মানোন্নয়নে সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়।
সাংবাদিকতা সভ্যতার বাহক ও উন্নতির প্রাণ ।এই পেশায় যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের নীতি- নৈতিকতা, মানবিকতা,পেশার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মানব সভ্যতার প্রাণ। এটি শুধু তথ্যের বাহক নয়, বরং সত্য, ন্যায় ও মানবমুক্তির এক অবিচল অনুসন্ধান। সাংবাদিকতার উৎকর্ষ তাই কোনো পেশাগত সীমায় বন্দী নয়;এ পেশায় শিক্ষা,অভিজ্ঞতা,পেশাদারিত্ব একজন সাংবাদিককে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যা মানব সভ্যতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নৈতিকতার উচ্চতর চর্চা এবং জ্ঞানের অন্বেষণ। আর এই উৎকর্ষের ধারায় সংগঠন হলো সেই প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো, যা বিচ্ছিন্ন কণ্ঠগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এক প্রবহমান প্রজ্ঞায় পরিণত করতে পারে।
সোশ্যাল হেরমে নিউটিক্স (Social Hermeneutics) কথাটি এখানে প্রাসঙ্গিক। সাংবাদিকতা এক ধরনের সামাজিক হের্মেনিউটিক্স— সমাজের অর্থ, সংকট ও চেতনার পাঠোদ্ধার। সমাজ, সংস্কৃতি,রাজনীতি,গণমানুষের কর্মকাণ্ড,আচরণ, বক্তব্য এইসবের অর্থ কিভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বা বিশ্লেষণ করা হয় সে বিষয়ে সাংবাদিকদের অগাধ পাণ্ডিত্য থাকে। সমাজের প্রতিটি বক্তব্য,সংবাদ বা ঘটনাই শুধুমাত্র ঘটনা নয় বরং এর পেছনে অর্থ-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট লুকিয়ে থাকে যা একজন বিচক্ষণ সাংবাদিকই উদ্ধার করতে পারেন।কিন্তু ব্যক্তি সাংবাদিকের উপলব্ধি সীমিত; তার পরিধি বাড়ায় সংগঠন। সংগঠন হলো অভিজ্ঞতার সম্মিলিত মঞ্চ, যেখানে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি রূপ নেয় সমষ্টিগত বোধে। এই সমষ্টিবোধ সাংবাদিকতাকে দেয় নৈতিক দিকনির্দেশ, বৌদ্ধিক শৃঙ্খলা এবং দায়িত্ববোধের গভীরতা।
সংগঠন সাংবাদিকের একাকী চিন্তাকে সংহত করে সামাজিক প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত করে। এটি কেবল অধিকার বা নিরাপত্তার রক্ষাকবচ নয়, বরং চিন্তার ধারাকে ধারালো করে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করে এবং গণতন্ত্রের আত্মাকে পুনর্গঠিত করে। সাংবাদিকতার উৎকর্ষ তখনই সম্ভব, যখন সংগঠন সত্যের অনুসন্ধানকে নীতিগত ঐক্যে রূপান্তরিত করতে পারে।অধিকার,নিরাপত্তা আর অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে এক প্রকার প্রজ্ঞাময় মানুষে পরিণত করে এই সাংবাদিকতা পেশার সংগঠন।
সংগঠনের মাধ্যমে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে সাংবাদিককে শানিত করে এবং সাংবাদিকতাকে আরো উন্নত, দক্ষ করে গড়ে তুলে।
নৈতিকতায়,দায়িত্বে জাগ্রত করে সংগঠনের একে অপরের মধ্যে এই অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে ভালো-মন্দ বিচারকে আরো উন্নত করর।
এই পেশার মানোন্নয়ন একজন সাংবাদিকের জ্ঞান, নৈতিকতা ও অভিজ্ঞতা যত শক্তিশালী হোক, সমষ্টিগত প্রজ্ঞা ছাড়া সাংবাদিকতার উৎকর্ষ পূর্ণতা পায় না। সংগঠন সেই সমন্বিত শক্তি, যা বিচ্ছিন্ন কণ্ঠকে ঐক্যবদ্ধ করে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করে এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করে। প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, অধিকার রক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সংগঠন সাংবাদিকদের দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে।
রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাবসহ various পেশাজীবী সংগঠন গণমাধ্যমের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও আঞ্চলিক সাংবাদিকদের প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাব বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিদ্যমান। তবুও সংগঠনই সাংবাদিকতার নৈতিক চেতনা ও পেশার মর্যাদার রক্ষাকবচ।
সচেতন ও সংগঠিত সাংবাদিক সমাজই পারে নির্ভীক সাংবাদিকতা, আলোকিত গণমাধ্যম এবং উন্নত সমাজ গঠনে নেতৃত্ব দিতে। অতএব, সাংবাদিকতার উৎকর্ষ সাধনে যোগ্য নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল সংগঠনই একমাত্র পথনির্দেশক শক্তি।
লেখক:
শিক্ষক নেতা, বাংলাদেশ সাংবাদিক ক্লাব’ এর মহাসচিব।