
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি:
বায়েজিদ জোয়ার্দার

ষড়ঋতুর দেশে হেমন্ত মানেই শীতের আগমনী বার্তা। উত্তরের হিমেল হাওয়া, গাছের ঝরা পাতা, শিশির ভেজা ঘাস কিংবা ঘন কুয়াশায় চাদরে ঢাকা প্রকৃতি- সব মিলিয়ে চুয়াডাঙ্গায় নেমেছে হেমন্তের আবহ। প্রকৃতির এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে খেজুরের রস ও গুড় সংগ্রহের প্রস্তুতি। এবারের মৌসুমে জেলায় প্রায় ৭০ কোটি টাকার খেজুর গুড় বাণিজ্যের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
চুয়াডাঙ্গার প্রায় প্রতিটি গ্রামের ক্ষেতের আইল, রাস্তার ধারে আর পুকুরপাড়ে বেড়ে ওঠা খেজুরগাছগুলো স্থানীয় অর্থনীতির এক বড় ভরসা। প্রতি বছর শীত মৌসুমে এই খেজুরগাছ থেকেই রস ও গুড় উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে কয়েক হাজার পরিবার।
এখন জেলার গ্রামাঞ্চলে চলছে গাছিদের প্রস্তুতির ব্যস্ততা। গাছের ডালপালা পরিষ্কার, নলি লাগানো ও রস সংগ্রহের সরঞ্জাম প্রস্তুতিতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গায় বর্তমানে ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৬০টি খেজুরগাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০–১২ কেজি গুড় উৎপাদন সম্ভব। চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৫০০ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। চুয়াডাঙ্গা সদর
খেজুরা গ্রামের গাছি বখতিয়ার হোসেন জোয়ার্দার বলেন, “আমার ১১৫টি গাছ প্রস্তুত করেছি। দুই সপ্তাহ পর নলি বসানো শুরু করব। একবার গাছ চাঁছলে তিন–চার দিন রস ওঠে, তারপর তিন দিন শুকাতে হয়। শীত বাড়লে রসের মিষ্টিও বাড়ে।”
নফরকান্দির আজিজুল হক জানান, তাঁর ৮০টি গাছ প্রস্তুত। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে রস আহরণ শুরু হবে বলে আশা করছেন তিনি।
আকন্দবাড়িয়ার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “চুয়াডাঙ্গার নলেন গুড় আর পাটালির চাহিদা অনেক। পাটালি কিনতে দুদিন আগে সিরিয়াল দিতে হয়। এখন গুড় বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ২০০–২৫০ টাকায়, আর পাটালি ৩০০ টাকায়।”
সরোজগঞ্জের গাছি আসাদুল হোসেন বলেন, “আমার ১৩০টি গাছ প্রস্তুত। অগ্রহায়ণের শুরুতেই রস তুলব। শীত যত বাড়বে, গুড়ের মান তত ভালো হবে।”
দেশের সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজার ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে। গত বছর সেখানে গুড় বিক্রি হয়েছিল কেজিপ্রতি ২২০–২৮০ টাকায়, আর পাটালি বিক্রি হয়েছিল ৩০০ টাকায়। এবারও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গাছিরা রস জ্বালানোর সময় চিনি মেশানোর প্রবণতা বাড়িয়েছে, যা খাঁটি খেজুর গুড়ের সুনাম নষ্ট করছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, “গত বছর জেলায় গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছিল। এ বছরও ২ হাজার ৫০০ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শীতের তীব্রতা বাড়লে গাছিরা আরও ভালো মানের গুড় উৎপাদনে সক্ষম হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে খেজুরের রসে কোনো পাখি বা বাদুড় না বসে। প্রয়োজনে কলসির মুখে নেট দিতে হবে। আর গুড় তৈরীর সময় পরিমানে বেশি করতে অনেকই চিনি মেশান। চাষী ভাইদের বলবো – চিনি মিশিয়ে খেজুর গুড়ের সুনাম নষ্ট করবেন না। প্রয়োজনে দাম কয়েক টাকা বেশি নেন। কিন্তু ভেজাল করবেন না। এলাকার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত খেজুর গুড় উৎপাদন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বেশি বেশি খেজুর গাছ লাগতে হবে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। অন্যদিকে রস-গুড় আহরন করে ৪/৫ মাস জীবন- জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন কৃষকরা।