
—–এম নজরুল ইসলাম খান
ঢাকার সাভারে ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটি মধ্যে থুতু ফেলাকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে তা মিডিয়ার মাধ্যমে দেখে আমি শিক্ষক হিসেবে নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারলাম না।ভাবছিলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা আসছেন তারা আসলে কি শিখতে আসছে। শিক্ষায় কোন গলদ হচ্ছে কিনা বা শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে কিনা?প্রকৃত শিক্ষার অভাব আছে বলে মনে হলো।মাঝে মাঝে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা কলেজও সংঘর্ষ লিপ্ত হয়। ডক্টর মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ ও সরকারি সোহরাওয়ারদী কলেজের মধ্যে সংঘর্ষ-ভাঙচুর হলো। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ-সেনা সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়, শিক্ষার্থীরা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়, এবং কয়েকটি মামলা ও দায়ের করা হয়েছিল।মাঝে মাঝে মনে হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জীবন রক্ষা হবে না, পরস্পর মধ্যে খুন-খারাবির মধ্যে লিপ্ত হয়ে যাবে। আমাদের শিক্ষার্থীর মধ্যে এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা অনেক আগে থেকেই চলছিল। আমরা একসঙ্গে থাকার শিক্ষাটা অর্জন করতে পারছি কি?আমাদের শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য বা শিক্ষার লক্ষ্য -মানবিকতা, মর্যাদা একসাথে থাকা এবং মনুষ্যত্বের শিক্ষা এসব কি আমরা অর্জন করতে পারছিনা?
এলাকায় এলাকায়, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ের, গোত্রে গোত্রে বৈষম্য, বিভেদ, ঘৃণা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষোভ, হিংসা এমনকি সন্ত্রাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ কেই কিন্তু কেন?
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ছাত্রদের মধ্যে গ্রুপিং বা তাদের মতবেদের কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মারামারি ও অগ্নিকাণ্ড বা অপহরণ সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
শিক্ষা মানব জীবনের আলোকবর্তিকা। শিক্ষা শুধু মানুষকে পড়া-লেখা শেখায় না, বরং মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শক্তি জোগায়। আধুনিক যুগে আমরা শিক্ষাকে প্রায়ই চাকরি, জীবিকা বা পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে যুক্ত করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল জ্ঞান অর্জন বা জীবিকা নির্বাহ নয় — বরং মানুষে মানুষে বোঝাপড়া, সহানুভূতি ও একসঙ্গে থাকার কৌশল শেখানোই এর আসল লক্ষ্য।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য
ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষার চারটি মৌলিক স্তম্ভের একটি হলো “Learning to Live Together”, অর্থাৎ একসঙ্গে বাঁচার জন্য শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে শেখায় কিভাবে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে ও শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হয়।
জ্ঞান ও দক্ষতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মানবিকতা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা। এই গুণগুলিই সমাজে শান্তি, ঐক্য ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে।
ব্যক্তিকে অন্যের চিন্তাধর্ম সংস্কৃতি ও মতবাদকে শ্রদ্ধা করতে শেখায় বিভেদ নয় ঐক্য সমরিতার মানসিকতা গড়ে তোলা এই শিক্ষা
শিক্ষকেরা এই মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার প্রধান কারিগর। তারা শিক্ষার্থীদের কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, বরং জীবনের পাঠও শেখান। শ্রেণিকক্ষে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষকই শেখান — “আমরা একসঙ্গে থাকলেই সমাজ এগিয়ে যায়।”শিক্ষক এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, দলগত মনোভাব,সহনশীলতা তৈরি করতে পারেন। শ্রেণি কক্ষে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন, বিভিন্ন সংস্কৃতি ধর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তুলে ধরতে পারেন, নৈতিক শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে সত্যিকারের মানুষ হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা একে অপরের মতামতকে সম্মান করা,ভিন্ন মতকে গ্রহণ করা, দলগত কাজে অংশগ্রহণ করা, সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলে একে অন্যের সহমর্মিত, সহযোগিতা এবং সাহায্যের চর্চা করবে। সংঘাত ও বিরোধের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে।
বর্তমান বিশ্বে দ্বন্দ্ব, সহিংসতা ও বিভেদের কারণ হলো একসঙ্গে থাকার কৌশলের অভাব। যদি শিক্ষা মানুষকে শুধু পেশাগতভাবে নয়, সামাজিক ও নৈতিকভাবেও পরিপূর্ণ করে তোলে, তাহলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি, ন্যায় ও সৌহার্দ্য।
শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল করা বা চাকরি পাওয়া নয়; বরং একজন মানুষ হিসেবে সমাজে দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল নাগরিক হয়ে ওঠা। তাই বলা যায় —শিক্ষা শুধু মাথাকে সমৃদ্ধ করে জ্ঞানী করে না বরং হৃদয়কেও মানবিক করে তুলে।
“শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য জ্ঞান নয়, মানুষ হওয়া এবং একসঙ্গে থাকার কলা শেখা।”