
এম নজরুল ইসলাম খান
সাংবাদিকতার উন্নতি ও মানোন্নয়নে সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়।
সাংবাদিকতা সভ্যতার বাহক ও উন্নতির প্রাণ ।এই পেশায় যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের নীতি- নৈতিকতা, মানবিকতা,পেশার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মানব সভ্যতার প্রাণ। এটি শুধু তথ্যের বাহক নয়, বরং সত্য, ন্যায় ও মানবমুক্তির এক অবিচল অনুসন্ধান। সাংবাদিকতার উৎকর্ষ তাই কোনো পেশাগত সীমায় বন্দী নয়;এ পেশায় শিক্ষা,অভিজ্ঞতা,পেশাদারিত্ব একজন সাংবাদিককে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যা মানব সভ্যতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নৈতিকতার উচ্চতর চর্চা এবং জ্ঞানের অন্বেষণ। আর এই উৎকর্ষের ধারায় সংগঠন হলো সেই প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো, যা বিচ্ছিন্ন কণ্ঠগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এক প্রবহমান প্রজ্ঞায় পরিণত করতে পারে।
সোশ্যাল হেরমে নিউটিক্স (Social Hermeneutics) কথাটি এখানে প্রাসঙ্গিক। সাংবাদিকতা এক ধরনের সামাজিক হের্মেনিউটিক্স— সমাজের অর্থ, সংকট ও চেতনার পাঠোদ্ধার। সমাজ, সংস্কৃতি,রাজনীতি,গণমানুষের কর্মকাণ্ড,আচরণ, বক্তব্য এইসবের অর্থ কিভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বা বিশ্লেষণ করা হয় সে বিষয়ে সাংবাদিকদের অগাধ পাণ্ডিত্য থাকে। সমাজের প্রতিটি বক্তব্য,সংবাদ বা ঘটনাই শুধুমাত্র ঘটনা নয় বরং এর পেছনে অর্থ-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট লুকিয়ে থাকে যা একজন বিচক্ষণ সাংবাদিকই উদ্ধার করতে পারেন।কিন্তু ব্যক্তি সাংবাদিকের উপলব্ধি সীমিত; তার পরিধি বাড়ায় সংগঠন। সংগঠন হলো অভিজ্ঞতার সম্মিলিত মঞ্চ, যেখানে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি রূপ নেয় সমষ্টিগত বোধে। এই সমষ্টিবোধ সাংবাদিকতাকে দেয় নৈতিক দিকনির্দেশ, বৌদ্ধিক শৃঙ্খলা এবং দায়িত্ববোধের গভীরতা।
সংগঠন সাংবাদিকের একাকী চিন্তাকে সংহত করে সামাজিক প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত করে। এটি কেবল অধিকার বা নিরাপত্তার রক্ষাকবচ নয়, বরং চিন্তার ধারাকে ধারালো করে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করে এবং গণতন্ত্রের আত্মাকে পুনর্গঠিত করে। সাংবাদিকতার উৎকর্ষ তখনই সম্ভব, যখন সংগঠন সত্যের অনুসন্ধানকে নীতিগত ঐক্যে রূপান্তরিত করতে পারে।অধিকার,নিরাপত্তা আর অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে এক প্রকার প্রজ্ঞাময় মানুষে পরিণত করে এই সাংবাদিকতা পেশার সংগঠন।
সংগঠনের মাধ্যমে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে সাংবাদিককে শানিত করে এবং সাংবাদিকতাকে আরো উন্নত, দক্ষ করে গড়ে তুলে।
নৈতিকতায়,দায়িত্বে জাগ্রত করে সংগঠনের একে অপরের মধ্যে এই অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে ভালো-মন্দ বিচারকে আরো উন্নত করর। অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য সাংবাদিকদের সংগঠন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণতা একজন সংবাদকর্মী মাত্রই বুঝতে পারেন।ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ঐক্যবদ্ধ না থাকলে প্রতিটা পদক্ষেপে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।
একতা, সহমর্মিতা বৃদ্ধি হয় এবং সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংগঠন গবেষণায়, সৃজনশীলতায় মানুষের মন-মানসিকতা উৎকৃষ্ট হয়।
সংগঠন অনেক সময় তাদের একে অপরের সহযোগিতা করে নিজের মিডিয়াটির আরো উন্নয়নে, আরো কার্যকর ভূমিকা রাখায় সংগঠনগুলি কাজ করছে।
রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাবগুলো বা সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন ক্লাব পেশাগত উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও পুরস্কার প্রদান করে সাংবাদিকতার মান উন্নয়নে অবদান রাখছে।
যদিও সংগঠনের গুলি ভূমিকা প্রশংসনীয় তবুও সংগঠনগুলির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কোন কোন সংগঠনের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য বিষয় প্রশ্ন করা যায় এবং তাদের কর্মতৎপরতা- কর্মসূচি দেখলে তাদের সাংবাদিক কর্মী হিসেবে অনেক সময় মনে হয় না। রাজনীতি প্রভাবিত সংগঠনের কথা বলছি।সাংবাদিকতার নীতি- নৈতিকতা,আদর্শের পরিপন্থী কাজ করা শোভনীয় নয়।
আছে আর্থিক সীমাবদ্ধতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাংবাদিকরা অনেক সময় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন এবং তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
আঞ্চলিক সাংবাদিকদের উন্নয়নে কাঙ্খিত পর্যায়ে সংগঠন নেই বললেই চলে, অতএব সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে এই পেশাকে উন্নত সাধন করতে হলে সংগঠিত ভাবে কাজ করতে হবে। জাতীয়ভাবে আঞ্চলিকভাবে সব জায়গায় সমান তালে এগিয়ে যেতে হবে।
সাংবাদিকদের সংগঠন কেবল সাংবাদিকতার সহায়ক নয়; এটি তার নৈতিক চেতনার কেন্দ্র। সংগঠনই সাংবাদিকতার দর্শনকে বাস্তবতায় রূপ দেয়— যেখানে জ্ঞান, নৈতিকতা ও স্বাধীনতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে আলোকিত গণমাধ্যম, এবং সমাজ পায় তার আত্মসচেতনতা। তাই, সাংবাদিকদের সার্বিক উন্নতি এবং মানোন্নয়নে দক্ষ সংগঠক তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞার মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশাকে উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে যাচ্ছেন,যাবেন। সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষ সাধনে সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক -দৈনিক নয়া বাংলা’র সম্পাদক, বাংলাদেশ সাংবাদিক ক্লাব’র মহাসচিব